রতকে যা দিয়েছি সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে’—উক্তিটি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে যিনি পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন ভারতেই। বর্তমানে তিনি ভারতের আতিথিয়েতায় দেশটিতে অবস্থান করছেন। সেই স্বৈরশাসকের উক্তির প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অঙ্গন, প্রশাসনসহ জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে—ভারতকে কী দিয়েছেন শেখ হাসিনা?
এনটিভির অনুসন্ধান বলছে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে অন্তত ২০টি চুক্তি ও ৬৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অন্তবর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দাবি, এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের অধিকাংশতেই উপেক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থ। ফলে চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন সরকারের একাধিক উপদেষ্টা।
ভারত ট্রানজিট পেলেও ‘সিঙ্গাপুরের মতো’ হয়নি বাংলাদেশ
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রতিবেশি দেশ ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় আসে। সে সময়ের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের মুখেমুখে ছিল সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, দুবাইয়ের মতো হয়ে উঠছে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো। অনেকে দেশটিকে খুব শিগগির ইউরোপ-আমেরিকার দেশের সঙ্গেও তুলনা হবে বলে প্রচারণা শুরু করেন। ‘ভারতকে ট্রানজিট দিলে’ এই সম্ভাবনার দ্বারে খুব অল্প সময়েই পৌঁছাবে বলে আলোচনা হচ্ছিল। যদিওর ওই সময় প্রস্তাবিত ট্রানজিটের বিপক্ষে বিএনপিসহ বিরোধী দল ও মতের মানুষ তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজ সিদ্ধান্তের পথে হেঁটে যায় শেখ হাসিনার সরকার।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশ প্রথম নৌ-ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে। এর আগে নৌ-মন্ত্রণালয় চুক্তির খসড়া পর্যালোচনা করে মতামত চেয়ে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। আইন মন্ত্রণালয় নেতিবাচক মতামত দিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণসহ তিন দফায় চুক্তির খসড়াটি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগ সূত্র বলছে, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিনিময়ে কোনো ধরনের শূল্ক বা ট্যারিফ আরোপের বিষয়টি চুক্তির খসড়ায় উল্লেখ করেনি। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ দফায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় আইন মন্ত্রণালয় ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার চুক্তির পক্ষে মতামত দিতে বাধ্য হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের অভিমতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার কথাটি উল্লেখ করে বলা হয়, ‘বিভিন্ন দেশের ট্রানজিট চুক্তির খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিনা শুল্কে ট্রানজিট দেওয়ার উদাহরণ (রেফারেন্স) নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ নির্দেশনা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাননীয় অর্থ উপদেষ্টার টেলিফোনে দেওয়া পরামর্শের আলোকে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির খসড়া পর্যালোচনা করে অভিমত দেওয়া গেল। তারপরও চুক্তিটি সম্পাদনের আগে এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও ট্রিটিসমূহ গভীরভাবে পর্যালোচনা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে এ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ অনুসরণ করার অনুরোধ জানানো হলো।’
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালের চুক্তির আওতায় ২০১৫ সালে ভারতের সঙ্গে আরও একটি প্রটোকল সই হয়। এ প্রটোকলের মাধ্যমে ভারতকে বাংলাদেশের চারটি নদীপথ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। এতে করে ভারতের কলকাতা ও মুর্শিদাবাদকে বাংলাদেশের পূর্বে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে।
পর্যায়ক্রমে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে সড়ক ও রেল ট্রানজিটও আদায় করে নিয়েছে। সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের পণ্যগুলো বাংলাদেশের সড়ক, রেল এবং জলপথে আখাউড়া আশুগঞ্জ ও আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের স্থল ও জলভাগ ব্যবহার করে নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথে ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পণ্য পরিবহণের বিনিময়ে কী পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ সরকার পেয়েছে তার সঠিক তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভারতকে ট্রানজিটের বিনিময়ে বাংলাদেশ ‘সিঙ্গাপুর’ হয়নি কেনো? এমন প্রশ্ন ছিল নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে। জবাব দেওয়ার জন্য তিনি দুদিন সময় নেন। তৃতীয় দিনে এনটিভি অনলাইনকে ওই কর্মকর্তা জানান, আসলে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের বিনিময়ে আমরা ভারতের কাছ থেকে কী পরমাণ অর্থ পেয়েছি, তার হিসাব করা হচ্ছে। ট্রানজিট চুক্তির পর প্রায় ১৪ বছর পার হতে চলেছে। দেশটি যেহেতু সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত হয়নি, তাই শুল্ক ও ট্যারিফ বাবদ খুব বেশি কিছু পেয়েছি তা বলা যাবে না।’
চট্রগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি
ট্রানজিট আদায় করে নেওয়ার পর ভারত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা পায়। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের এ দুটি বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারত বহু বছর ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রটোকল সই হয়। এ প্রটোকলের আওতায় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম এবং মংলা সমুদ্র বন্দরগুলোতে পৌঁছানো পণ্যসমূহ বাংলাদেশেল ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে সড়ক, রেল এবং জলপথে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরা, তামাবিল হয়ে মেঘালয় ও সুতারকান্দি হয়ে আসামে এবং বিবির বাজার হয়ে সীমান্তপুর (আসাম) আনা করতে পারবে।
২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল ভারতে চট্রগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের চুড়ান্ত অনুমতি দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত ‘অ্যাগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস ফ্রম ইন্ডিয়া’-এর আওতায় উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুযায়ী ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট পণ্যের কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এ আদেশ জারি করা হয়েছে। ফলে ভারত বন্দর দুটি ব্যবহার করে নিজ দেশে পণ্য পরিবহণ করতে পারবে। চট্টগ্রাম-আখাউড়া-আগরতলা, মোংলা-আখাউড়া-আগরতলা, তামাবিল-ডাউকি, শেওলা-সুতারকান্দি এবং বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর রুটে ১৬টি ট্রানজিট রুট খোলা হয়েছে।”
তিস্তার পানি চেয়ে দিতে হলো ফেনীর নদীর পানি
আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী তিস্তার উজানে গজলডোবাসহ কয়েকটি স্থানে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে চলছে। এতে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ একেবারেই তলানিতে। ফলে বাংলাদেশের গোটা উত্তরাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন ব্যহত হয়। বাংলাদেশ ১৯৮৩ সাল থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের চেষ্টা করে আসছে। ভারতও একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়েও পানিবন্টন চুক্তি করছে না। উল্টো আন্তর্জাতিক নদী শাসন আইন লঙ্ঘন করে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি হবে, এমন অঙ্গিকার করে উভয় দেশ। সফরে দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের আলোচ্য সূচিতে তিস্তা চুক্তির খসড়া তো দূরের কথা আন্তর্জাতিক এ নদীর পানির প্রবাহের কথাটিই ওঠেনি। উল্টো বাংলাদেশের নিজস্ব নদী ফেনীর পানি চেয়ে বসে ভারত। বৈঠকে শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদির আবদার ফেলতে পারেননি। দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারতকে এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এ চুক্তির আগে শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভার অনুমোদন নেননি বলে অভিযোগ ওঠে। পানি বিশেষজ্ঞরাসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন এ চুক্তির তীব্র সমালোচনা করে।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধতন এক কর্মকর্তা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ফেনী নদীর উৎপত্তি খাগড়াছড়িতে আর বাংলাদেশের ভেতরের ১১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পতিত হয়েছে। কাজেই এ নদীর পানির ওপর ভারতের কোনো অধিকার নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা জানান, তিস্তা হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক নদী। ভারত চাইলেই একতরফাভাবে এ নদীর পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। এটি আন্তর্জাতিক নদী শাসন আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন, কিন্তু ভারত সেটাই করে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
এ চুক্তির পর দেশে ফিরে শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলন করে সমালোচনার জবাব দেন। ভারতকে ফেনী নদীর পানি দেওয়ার পক্ষে সাফাই গেয়ে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ফেনী নদীর উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ হলেও এটি একটি সীমান্তবর্তী নদী। নদীর কিছু অংশ ভারতের সীমান্তেও লেগেছে। ফলে ত্রিপুরার মানুষকে কিছু পানি খাওয়ার জন্য দিচ্ছি। এ বিশাল নদীর কিছু পানি ভারতকে দেওয়ার ফলে এতো চিৎকার করা হচ্ছে কেনো? ভারত পান করার জন্য কিছু পানি চেয়েছে, আমরা দিয়েছি। এটা নিয়ে কিছু মানুষ খুব সমালোচনা করছে ও লেখালেখি করছে। আর বিএনপি তো সমালোচনা করেই চলেছে। তারা এটা নিয়ে সমালোচনা করছে কোন মুখে?’
মাসে ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি করে মোদির বন্ধু আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি
দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট। এ তথ্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়ার পরও ভারত থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ আমাদিনর চুক্তি করে শেখ হাসিনার সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে তার নয়াদিল্লি সফরের সময় ভারতের আদানি পাওয়ারের সাথে চূড়ান্ত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) স্বাক্ষর হয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত গৌতম আদানি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনি ব্যক্তিদের একজন। তিনি আদানি পাওয়ারের মালিক।
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম ঢাকা সফরের সময় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে প্রথম চুক্তি হয়।
দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভারতের আদানির সঙ্গে সম্পাদিত এ চু্ক্তি দেশের স্বার্থে নয়, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান আদানির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই সম্পাদন করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন বারবার দাবি করে আসলেও এ চুক্তিটি প্রকাশ করেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা এনটিভি অনলাইনকে জানান, এ চুক্তিতে কিছু নিয়ম ও বিধান বজায় রাখতে পারলে বিদ্যুৎ আমদানি খরচ অনেক কমে যেতো। বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় অতিরিক্ত ৭০০ কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বিদ্যুৎ আমদানির কয়েকটি অসঙ্গতি তুলে ধরে তিনি বলেন, চুক্তিতে যে ট্যারিফের কথা বলা হয়েছে তা আমাদের স্থানীয় কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ক্রয়মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ২৫ বছরে ভারতের আদানি পাওয়ারকে বাংলাদেশ প্রায় ২৩ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে, যা বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদয় রিজার্ভের চেয়েও বেশি।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারতের আদানি পাওয়ারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত ১১টি চুক্তি খতিয়ে দেখতে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের চুক্তি পর্যালোচনা’ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ইতোমধ্যেই ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত সব নথিপত্র তলব করেছে।
বাংলাদেশের আশীর্বাদপুষ্ট ভারতের রেমেট্যান্স!
বাংলাদেশে লাখো বেকার চাকরির জন্য ঘুরছেন। শিক্ষিত বেকার তরুণরা ভালো চাকরি প্রত্যাশায় অবৈধভাবে ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছে। কেউ আবার লিবিয়ার কারাগারে কিংবা থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে অরণ্যরোধন করে চলেছেন। এই অবস্থায় বাংলাদেশে ভারতের কয়েক লাখ মানুষ বৈধ ও অবৈধভাবে চাকরি করছেন। ভারতে রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নামও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ তথ্য বলছে, ‘২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে কর্মরত বিদেশিরা ৯ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নিজ দেশে পাঠিয়েছেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা দাঁড়ায় ১১ কোটি ৫০ লাখ ডলারে। আর এই টাকা পাঠানোর দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ভারতীয়রা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, গত অর্থবছরে চার কোটি ৪০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স গেছে ভারতে, যা দেশের বাইরে যাওয়া রেমিট্যান্সের মধ্যে সর্বোচ্চ।’
অসংখ্য বাংলাদেশি বেকার থাকলেও বাংলাদেশের শ্রম বাজারে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় কাজ করছেন বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন৷ গত ২৬ জানুয়ারি এক আলোচনায় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে অবশ্যই আনডকুমেন্টেড ভারতীয়রা কাজ করছে৷ আনঅফিশিয়ালি বাংলাদেশ থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ভারতে রেমিট্যান্স যায়৷’ এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই সচিব বলেন, ‘ডকুমেন্টেড করলে কিছু ঝামেলা আছে৷ বিভিন্ন কোম্পানি যারা তাদেরকে নিয়োগ দেয় তারা হয়তো ভাবে, বাংলাদেশি নেওয়ার থেকে ভারতীয় নিয়োগ দিলে তাদেরকে এতো অধিকারের ব্যাপারে চিন্তা করতে হয় না৷ তারা যখন তখন চাকরি ছেড়েও যাবে না৷’
বাংলাদেশের চাকরির বাজার নিয়ে কাজ করা সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো বিডিজবস ডটকম৷ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘কর্মরত বিদেশিদের মধ্যে ভারতীয়রাই শীর্ষে৷ তারপরে শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড৷ এদেরমধ্যে শতকরা ১০ ভাগেরও ওয়ার্ক পারমিট নেই৷ অধিকাংশই অবৈধভাবে কাজ করেন৷ তাদের পেমেন্টও এখানে করা হয়না৷ ভারতীয় হলে তার পেমেন্ট ভারতেই দেয়া হয়৷ যারা নিয়োগ করেন তারা এরকম একটা সিস্টেম গড়ে তুলেছেন৷’
পাঠ্যপুস্তক বাংলাদেশের ছাপানো হতো ভারতে
প্রতিবছর দেশের স্কুল, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমিক পর্যায়ের এক কোটি ৮৯ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ২৩ কোটির বেশি কপি বইয়ের প্রয়োজন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এসব পাঠ্য বইয়ের যোগান দেয়। এনসিবিটির বই ছাপানোকে কেন্দ্র করে দেশে একটি বিশাল প্রকাশনা শিল্প গড়ে ওঠে। এ শিল্পের সঙ্গে দেশের কয়েক লাখ মানুষ যুক্ত হয়। কাগজ আমদানি, ছাপাখানা তৈরি, বই ছাপানো, বাঁধাই ও সরবরাহের কাজে সরগরম থাকতো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার্থীদের এসব পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর দায়িত্ব ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনার আমলে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ করায় প্রথম দিকে ব্যাপক আন্দোলন করে দেশের ছাপাখানার মালিক ও কর্মীরা।
আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী বছরের জন্য প্রাথমিকের প্রায় এক কোটি পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পায় ভারতীয় প্রিতম্বর বুকস প্রাইভেট লিমিটেড ও পাইওনিয়ার প্রিন্টার্স নামের দুই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। দেশের প্রকাশকদের বাদ দিয়ে ভারতীয় প্রকাশকদের বই ছাপাতে দেয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকেই।
ব্যাপক সমালোচনার পর গত ২৮ অক্টোবর ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া বই ছাপানোর কার্যাদেশ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ভারতের কব্জা থেকে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ বাংলাদেশে পুরোপুরিভাবে ফিরে আসায় দেশের প্রকাশনা শিল্প ফের সরগরম হয়ে ওঠবে বলে আশা করছেন প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।
স্বার্বভৌমত্বকে হুমকিতে রেখে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চু্ক্তি
২০১৪ সালে শেখ হাসিনা টানা দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার পরপরই ভারতের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চু্ক্তি করতে যাচ্ছেন বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠতে থাকে। এ ধরনের একটি চুক্তি হলে বাংলাদেশ সিকিম ও হায়দারাবাদের মতোই স্বাধীনতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে সিকিম ও হায়দারাবাদ দুটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। বিভিন্ন চুক্তির বেড়াজালে ফেলে ভারত এ দুটি দেশকে নিজেদের অংগ রাজ্য হিসেবে দখল করে নেয়।
বিভিন্ন মহলের আপত্তি ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি সই করেন। ২০১৮ সালের ১২ মে দেশের একটি প্রভাবশালী দৈনিক এ চুক্তি নিয়ে একটি বিষদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় ঋণ বাস্তবায়ন এবং সার্বিক সহযোগিতার বিস্তার ঘটাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মোট চারটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে যে ৫০০ মিলিয়ন ঋণ দিয়েছে, কীভাবে সেই অর্থ ব্যয় হবে তার রূপরেখা ঠিক করা ছাড়াও সই হয়েছে আরও তিনটি সমঝোতা স্মারক। বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লে. জেনারেল মাহফুজ রহমানের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল এই বিষয়ে বৈঠক করে ভারতের প্রতিরক্ষাসচিব সঞ্জয় মিত্রর সঙ্গে। ঋণের অর্থ কীভাবে খরচ হবে, কোন কোন প্রতিরক্ষাসামগ্রী কেনাবেচা হবে, সহযোগিতার ক্ষেত্র কোথায় কীভাবে বাড়ানো হবে, তা আলোচনার পর একটা কাঠামো বা ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের যেসব প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রয়োজন ভারত যদি সেসব তৈরি করে, তাহলে দুই দেশের সম্মতিতে তা কেনাবেচা হবে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের প্রয়োজনভিত্তিক চাহিদাপত্র ভারতকে দেবে, তা পাওয়ার পর ঠিক হবে ভারত কী কী সরবরাহ করতে পারে।
হাইকমিশন সূত্রের খবর, প্রতিরক্ষা খাতে যে ৫০ কোটি ডলার ভারত ঋণ দিচ্ছে, তার পুরোটাই যে ভারত থেকে আমদানির মাধ্যমে খরচ করতে হবে তা নয়। চুক্তির একটা অংশ (প্রায় ৩৫ শতাংশ) তৃতীয় দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনে বাংলাদেশ খরচ করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ভারতের অনুমতি নিতে হবে।
দুই দেশের মধ্যে অন্য যে তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তার দুটি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের নৌবাহিনীর। খুলনায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শিপইয়ার্ডের সঙ্গে যৌথভাবে নৌ-জাহাজ তৈরি করা এই দুই বোঝাপড়ার লক্ষ্য। চতুর্থ সমঝোতা দুই দেশের সামরিক স্কুলের শিক্ষার্থী বিনিময় নিয়ে। এর ফলে শুরু থেকেই পরস্পরকে চেনাজানার সুযোগ হয় এবং সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে আগে থেকেই প্রশিক্ষণ বিনিময় চালু আছে। চালু আছে দুই বাহিনীর মধ্যে সামরিক মহড়াও। তার ব্যাপ্তিও ঘটছে। এই সমঝোতা স্মারক তার পরিধি আরও বাড়াবে।
ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সমঝোতার বিষয়টি বাংলাদেশের কাছে যথেষ্টই স্পর্শকাতর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে থেকেই এই সমঝোতা নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে কি না, সেই সংশয় বিভিন্ন মহল প্রকাশও করেছিল। কিন্তু সেই সব আশঙ্কা উপেক্ষা করে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হয়।
ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়চুক্তি
বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের তিন পাশের প্রায় পুরোটাই ভারত দ্বারা বেষ্টিত। সেই ভারতের সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে অত্যন্ত গোপনে এ চুক্তি করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। এ চু্ক্তির পর ২০২২ সালে ৬ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব বিনয় মোহন কাত্রা সাংবাদিকদের এ চুক্তির কথা জানান।
৫০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিটির বিষয়ে প্রতিরক্ষা সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিরক্ষা এলওসির (লাইন অব ক্রেডিট) অধীনে প্রথম চুক্তিটি এই সপ্তাহের শুরুতে স্বাক্ষরিত হয়েছে। আমি নিশ্চিত যে, আপনারা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। সামান্য পরিমাণে হলেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিরক্ষা এলওসি হলেও এটি উন্নয়ন অংশীদারত্ব কাঠামোর একটি অংশ। নিরাপত্তা ও কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা আছে।’
এই প্রচেষ্টা প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দুই দেশের পারস্পরিক অংশগ্রহণ আরও উন্মুক্ত করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন বিনয় মোহন কাত্রা।
সীমান্ত হত্যা বন্ধে শেখ হাসিনার নতজানুনীতি
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশের মন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য ‘বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গ স্বামী-স্ত্রীর মতো’ কিংবা ‘বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ। কেউ বলেছেন, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। অথচ, সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে অংসখ্য বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। হতভাগা ফেলানিকে গুলি করে হত্যার পর তার মৃতদেহ কাঁটাতারের বেড়ার ওপর ঝুলিয়ে রেখেছে।
ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে সীমান্তে মানুষ মারা গেলেও বাংলাদেশের মন্ত্রীরা এর জন্য উল্টো নিহতদেরই দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন। তারা বিএসএফকে মোটেও দায়ী করতে রাজি ছিলেন না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ করতে হলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই বলে বক্তব্য দিয়ে ভাইরাল হয়েছিলেন বাংলাদেশের সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি এক সভায় সাধারন চন্দ্র বলেন, ‘আসলে আমাদের চরিত্র যদি ভালো না হয়, পরের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এখানে দোষ বাংলাদেশি নাগরিকদেরই, সুতরাং সরকারের কিছুই করণীয় নেই। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০০৯ সাল ১৫ বছরে প্রায় পাঁচশ বাংলাদেশি নাগরিককে সীমান্তে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত-রক্ষী বাহিনী বিএসএফ। বাংলাদেশ কখনোই এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেনি। বরাবরই শেখ হাসিনার সরকার নতজানু নীতি অনুসরণ করে চলেছে।
দেশে ঢুকে বিজিবি সদস্যকে হত্যার পর লাশ নিয়ে গেলেও চুপ ছিলেন শেখ হাসিনা
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সুখ্যাতি পায় ‘ডামি নির্বাচন’ নামে। এই ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চারবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসেন শেখ হাসিনা। এ নির্বাচনেও শেখ হাসিনাকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দেয় ভারত। নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে ডেকে নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন বলে দাবি ওঠে। দেশে ফিরে এই দাবি তোলেন তিনি নিজেই। যদিও ভারতের প্রেসক্রিপশন প্রকাশ করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলেও সাংবাদিকদের জানান জাপা চেয়ারম্যান।
ক্ষমতায় বসে শেখ হাসিনা ভারতের প্রতি কতটা অনুগত, তার পরীক্ষাও নেওয়া হয়। নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর ২২ জানুয়ারি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) যশোরের শার্শা উপজেলার ধান্যখোলা সীমান্তে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিজিবি সদস্য করে গুলি করে হত্যা করে তাদের মৃতদেহ ভারতে নিয়ে যায়। অবশ্য দুদিন পর ভারত বিজিবি সদস্যের মরদেহ ফেরত দেয়। বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের ভেতরে ঢুকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন সদস্যকে হত্যা করে লাশ নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় দেশের মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মালেও চুপ ছিলেন শেখ হাসিনা। এভাবে পরীক্ষার খাতায় অনেকটাই এগিয়ে যান স্বৈরশাসক।
পরে সচিবালয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে এ বিষয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আপনারা আমার কাছে এমন একটি প্রশ্ন করেছেন সেটাও মিডিয়াতে আনবেন না। এ বিষয়টি পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখভাল করছেন।’
বিষয়টি নিয়ে ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কাছেও প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। জবাবে হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘এমন কোনো ঘটনা আমি এখনও শুনিনি। আগে জেনে পরে আপনাদের প্রশ্নের জবাব দেব।’ যদিও এরপর এ বিষয়ে আর কোনো উত্তর দেননি হাছান মাহমুদ। তবে, সাবেক নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এমন ঘটনায় আমাদের বন্ধুপ্রতীম দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সমর্কে কোনো সমস্যা হবে না।’
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত থেকে সরে আসেন শেখ হাসিনা
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি অন্য দিনের মতোই সোনালি আভা ছড়িয়ে পূর্বদিগন্তে সূর্য ওঠে। কর্মব্যস্ত দিন শুরু হয়েছে মাত্র। তখনই সবাইকে হতবাক করে দিয়ে নরকে পরিণত হয় রাজধানীর বিডিআর সদর দপ্তর। মাত্র ৩৬ ঘণ্টার ব্যবধানে বিডিআররের তৎকালীন মহাপরিচালকসহ (ডিজি) দেশের মেধাবী ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয় এ বিদ্রোহে।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের সীমান্তকে অরক্ষিত করে তোলা। আর এ ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রকাশ্যভাবে প্রতিবেশি দেশ ভারতের ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এ কারণেই এ ঘটনার আর আন্তর্জাতিক কোনো তদন্ত হয়নি বলেও অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব.) মঈন ইউ আহমেদও তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে। নিজের ইউটিউভ চ্যানেলে সাবেক এ সেনা প্রধান বলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহ ঘটনার আমি যখন তদন্তের আদেশ দেই, তখন আমাকে বলা হয় যখন সরকার এই বিষয়ে তদন্ত করছে, তখন আমাদের এর প্রয়োজনটা কী? এই তদন্ত করতে ওই সময় সরকারের কাছ থেকে যে সাহায্য প্রয়োজন তা আমরা পাইনি।’
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতকে সরাসরি দায়ী করেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম, যিনি বিডিআর হত্যকাণ্ডের পরপরই বিজিবি মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁকে এ বিষয়ে তিনটি প্রশ্ন করা হয়েছিল।
প্রথম প্রশ্নে ‘ইন্ডিয়ানদের প্রসঙ্গ এলো কেন’র উত্তরে মইনুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ইন্ডিয়ান বিএসএফ পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বর্ডারের খুব কাছে অবস্থান নিয়েছিল। যুদ্ধের পর ইন্ডিয়ান বিএসএফ কয়েকটি ঘাঁটি ছেড়েছিল। আবার কোথাও কোথাও ছাড়েনি। বিডিআরের তুলনায় ইন্ডিয়ান বিএসএফ দুর্বল ছিল। কারণ, বিএসএফের কমান্ডিংয়ে আর্মি ছিল না। কিন্তু বিডিআরের কমান্ডে ছিল আর্মি। ইন্ডিয়ান বিএসএফ তাদের ক্যাম্পের সীমা পেরিয়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিওপিতে অবস্থান করছিল সেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। ১৯৭৫ সালের পর ১৯৮১ সালের আগে ইন্ডিয়ান বিএসএফকে বাংলাদেশের বিওপি ছাড়তে বাধ্য করার জন্য বেশ কয়েকটি অপারেশন শুরু হয়েছিল। অপারেশনে ইন্ডিয়ান বিএসএফ পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। ইন্ডিয়া এটার কাউন্টার কখনো করেনি বা করতে পারেনি। সেই সক্ষমতা বিএসএফের ছিলও না। সেই সুযোগও বিএসএফ পায়নি। ইন্ডিয়া সব সময়ই চেয়েছিল, কীভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা যায়। পিলখানা হত্যাকাণ্ড ছিল মোক্ষম সময়। সেনাবাহিনীর সবগুলো মেধাবী কর্মকর্তাকে দুদিনের মধ্যে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। এটা সবাই সেভাবেই দেখে। এই বিষয়টিও তখন আমলে নেওয়া জরুরি ছিল, বিভিন্ন পক্ষ থেকে কথাও এসেছিল। এর ওপর পিলখানার পরিস্থিতি বিশেষ করে অস্ত্রাগারের পরিবেশ দেখে পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছিল এটি পরিকল্পিত ভাবেই ঘটানো হয়েছিল এবং সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনার পেছনের লোকজন ২০-২১ দিন আগেই এখানে ঢুকেছিল।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রশ্নে ইন্ডিয়ার সম্পৃক্ততার আলামত ও অন্য কারও সম্পৃক্ততা বিষয়ে জানতে চাইলে মইনুল ইসলাম বলেন, ইন্ডিয়া সবসময়ই বিডিআরের কমান্ডিংয়ে আর্মি এবং ১৯৮১ সালের আগের বেশ কয়েকটি অপারেশন এবং পরবর্তিতেও বেশ কয়েকটি অপারেশন নিয়ে প্রতিশোধপরায়ণ ছিল। তারা চেষ্টাও করেছিল। এখানেই পরিষ্কার, এখানে ইন্ডিয়ার ইন্ধন ছিল। তিনি আরও বলেন, আমরা যখন বিডিআর (বিজিবি) রিফর্ম করি তখনও ইন্ডিয়ানদের অনেক বাধার মুখে পড়েছি। আর্মি কেন বিডিআরকে কমান্ড করে এটাও ইন্ডিয়া সহ্য করতে পারত না। সঠিক তদন্ত করলে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসত। আরো অনেকের সম্পৃক্ততা ছিল। তা-ও বেরিয়ে আসত।
মইনুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক একটি পক্ষের সম্পৃক্ততা ছিল। বিদ্রোহের আগে বেশ কয়েকবার স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সদর দপ্তরে বিভিন্ন ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকালে অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বিডিআরের অভিযুক্ত জওয়ানদের পক্ষে দাবি নিয়ে যেতে দেখা গেছে। বিদ্রোহের দিন বিডিআরের কিছু লোক রিভেঞ্জ (প্রতিশোধপরায়ণ) ছিল। তাদের সাথে আশপাশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন ছিল। কেন বিডিআর আর্মি অফিসার দ্বারা পরিচালিত হবে- এসব নিয়ে কথাও বলেছেন তারা। ঘটনার দিন পিলখানায় গোলাগুলি চলছে, আশপাশের সাধারণ মানুষ জীবন নিয়ে নিরাপদে সরে যাচ্ছিলেন। আর পাশেই বিদ্রোহীদের পক্ষে আজিমপুরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ রাস্তায় মিছিলও করেছে। নিশ্চয়ই তাদেরও সমর্থন ছিল এই ঘটনায়। আর তারাও নিশ্চিত ছিল তাদের ওপর কেউ গুলি করবে না। সেগুলোও তদন্ত করা হয়নি। সবকটি পক্ষ মিলেই আর্মিকে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল।
ভারতের সঙ্গে ‘গোলামি’র রেল চুক্তি
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে পণ্য ও মালামাল আনার-নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বেগ পেতে হয় ভারতকে। মাঝখানে বাংলাদেশ থাকায় দেশের অন্য অংশের সাথে রাজ্যগুলোর পণ্য পরিবহণ বেশ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। সেই কারণেই বাংলাদেশের কাছে পণ্য ট্রানজিট সুবিধা চেয়ে আসছিল ভারত।
ছাত্র-জনতার তীব্র গণআন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে পলায়নের মাত্র দুই মাস আগে দেশটিতে যান শেখ হাসিনা। ওই সফরটিই ছিল শেখ হাসিনার শেষ আনুষ্ঠানিক সফর। এ সফরে তিনি ভারতকে রেল ট্রানজিট প্রদানে সম্মতি দিয়ে আসেন। এটিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন ‘গোলামির চুক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করে তীব্র সমালোচনা করেন। তারা চুক্তিটি প্রকাশ করারও দাবি জানান। ভারতকে একতরফা রেল ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়ে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যম বিশ্লেশষণধর্মী সংবাদ প্রকাশ করে।
রেল ট্রানজিট চুক্তির পর শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা হলেও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা সাংবাদিদের জানান, ‘এই ট্রানজিট চালু হলে নিজ দেশের মধ্যে রেলপথে দূরত্ব অনেকখানি কমবে ভারতের।’
ভারতের স্বার্থ রক্ষায় রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্যমতে, ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সেই দেশের ছত্তিশগড়ে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গ্রিন প্যানেলের ইআইএ রিপোর্ট প্রকল্পটিকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে প্রতিবেদন দাখিল করায় ভারত সরকার এ প্রকল্পটি সেদেশের পরিবর্তে বাংলাদেশে করার প্রস্তাব করে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেখানে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সঞ্চালনের একটি প্রস্তাব ছিল। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে ২০১২ সালে সুন্দরবনের নিকটবর্তী রামপালে দুটি ৬৬০ ইউনিট মিলে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর কোনোরূপ পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ না করেই প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের আদেশ জারি করা হয় এবং অবকাঠামো উন্নয়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়।
সুন্দরবনের সঙ্কট দূরত্বের মধ্যে এই কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবেশ ঝুঁকি বিবেচনা করে বাংলাদেশের পরিবেশবিদরা প্রতিবাদ করেন এবং এক পর্যায়ে পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সার্টিফিকেট না নিয়ে এই প্রকল্প চালুর বিষয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করে। এমতাবস্থায় তড়িঘড়ি করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ইনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে এই প্রকল্পকে পরিবেশবান্ধব বলে সার্টিফিকেট দেয় এবং সেই প্রতিবেদন অনলাইনে আপলোড করে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। বিতর্কিত ইআইএ প্রতিবেদনকে সঠিক ধরে নিয়েই ঢাকায় ভারতের সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্বাক্ষরিত তিনটি চুক্তির মধ্যে রয়েছে- যৌথ উদ্যোগ চুক্তি, বাস্তবায়ন চুক্তি ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি।
তীব্র সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে ২০২২ সালের শেষ দিকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা হলেও কারিগরি ত্রুটি, কয়লা সংকট ও অন্যান্য কারণে এখন পর্যন্ত মোট সাতবার বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মূলত ভারতের আবদার রক্ষার জন্যই করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশেল জন্য কখনোই লাভজনক হবে না। এটি দেশের জন্য একটি বিশাল বোঝা ছাড়া আর কিছু্ই নয়।
এদিকে, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর আগে সরেজরিমনে গিয়ে দেখা গেছে, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ শ্রমিক থেকে শুরু করে কারিগরি কাজে যুক্তদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ভারতের নাগরিক। খুব সামান্য সংখ্যকই বাংলাদেশের নাগরিক। ভারতীয় নাগরিকদের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে দৈনন্দিন প্রয়োজনের ব্যবহৃত সবকিছুই শ্রমিকরা ভারত থেকে আমদানি করেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ভারতীয়দের দখলে তুলে দেওয়া হয় বাংলাদেশের আইটি
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিখাতে ভারতের একচেটিয়া প্রাধান্য রয়েছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের আইটি খাতে এখন ভারতীয় নাগরিকদের রাজত্ব চলছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, এসব খাতে এখন প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় নাগরিক কাজ করছে। এর মধ্যে শতকরা মাত্র ১০ ভাগ বৈধভাবে। বাকি ৯০ ভাগই অবৈধভাবে কাজ করছে। পোশাকের বায়িং হাউসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয়রা৷
চীনকে পাশ কাটিয়ে ভারতকে তিস্তা প্রকল্প দেওয়ার পরিকল্পনা
ভারত তিস্তা নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে বাংলাদেশ উত্তরাঞ্চলে দিনদিন মরুময়তা তৈরি হচ্ছে। এতে কৃষি ফলন মারাত্মক ব্যহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যই বাংলাদেশ তিস্তা মহাপ্রকল্প নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। চীন এ প্রকল্পে অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। অথচ, চলতি বছরে শেখ হাসিনা ভারত সফর করে দেশে ফিরে হঠাৎ করেই তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে উল্টো কথা বলা শুরু করেন। তিনি তিস্তা প্রকল্প ভারতকে দিয়ে করাবেন বলে ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিস্তা প্রকল্প আমাদের করতে হবে। এ নিয়ে চীন-ভারত দুই দেশই আমাদেরকে প্রস্তাব দিয়েছিল। এরই মধ্যে চীন সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ভারতও সম্ভাব্যতা যাচাই করবে। দুই দেশের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত হবে আমরা সেটা নেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখানে বেশি প্রাধান্য দেবে যে এটা ইন্ডিয়া করুক। কারণ তিস্তার পানিটা ইন্ডিয়া আটকে রেখেছে। তাদের কাছ থেকে যদি আমাদের আদায় করতে হয় তাহলে এই প্রজেক্টের কাজ তাদেরই করা উচিত। তারা প্রজেক্ট করে যখন যে প্রয়োজন তারা দেবে। এটা তো একটা ডিপ্লোমেসি।’
হাসিনা জানান, ‘এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন তো রেডি, কিন্তু আমি চাচ্ছি এটা ইন্ডিয়া করে দিক। তাহলে এই প্রজেক্টের জন্য যা যা দরকার, ইন্ডিয়া দেবে।’
বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অবাধ সম্প্রচার
বাংলাদেশ ও ভারত অকৃত্রিম বন্ধুত্বের সব সীমা অতিক্রম করেছে বলে প্রতিনিয়ত বলতেন শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা। যদিও বহু চেষ্টার পরও ভারতে বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার চালু করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে, বাংলাদেশে ভারতের একশটিরও বেশি টিভি চ্যানেল সম্প্রচার চালিয়ে আসছে। সেইসঙ্গে শত কোটি টাকার বিজ্ঞাপন ব্যবসাও ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই নিয়ন্ত্রণ করেছে।
ভারতের জি ও স্টার গ্রুপের দুটি চ্যানেল ‘জি বাংলা’ ও ‘স্টার জলসা’ আলাদা বিমে বাংলাদেশে মাত্র তিন লাখ টাকায় ডাউনলিংক করে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন নিয়েছে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদের হিসাবে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন পেয়েছে এ দুটি চ্যানেল। অথচ, বাংলাদেশ কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬-এর ১৯ (১৩) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশি কোনো টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।
বাংলাদেশ ছিল ভারতের উম্মুক্ত বাজার
২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৭১৬০.৮১ মিলিয়ন ডলার। এমন বাণিজ্য ঘাটতি বিশ্বে বিরল ঘটনা বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ ভারতের একটি উম্মুক্ত বাজারে পরিণত হয়েছিল গত ১৫ বছরে।
দেশের চাহিদা অনুযায়ী অনেক পণ্যই আমদানি করতে হয়। কিন্তু বিকল্প বাজার না খুঁজে সবকিছুই ভারত থেকে কিংবা ভারতের মাধ্যমে আমদানি করা শেখ হাসিনার একটি প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেও জানান অর্থনীতিবিদরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর স্থলপথে দু’দেশের মধ্যে এক কোটি ৬০ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় এক কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৩ টন পণ্য। এ সময় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩৮ টন পণ্য। অর্থাৎ প্রায় ৯৪ শতাংশই ভারতের অনুকূলে। ভারত থেকে আমদানি হয় এমন পণ্যের তালিকায় রয়েছে তুলা, সুতা, বস্ত্র, শিল্পের বিভিন্ন রাসায়নিক, পাথর, আদা-রসুন-পেঁয়াজ, সব ধরনের মসলা, বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফল।