এই মুহূর্তে মোটাদাগে দুটি বড় যুদ্ধ চলমান আছে পৃথিবীর বুকে। একদিকে আড়াই বছর ধরে চলা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যেকোনো একপক্ষ বেপরোয়া হয়ে উঠলে যার বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো ইউরোপে।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য অস্থিরতা, দখলদার ইসরায়েল ও বিবাদমান পক্ষগুলো সমঝোতায় না এলে যেকোনো মুহূর্তেই এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে আরও কয়েকটি দেশে। যেকোনো একটির বিস্তৃতিই মহাবিপর্যয় নামিয়ে আনতে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে; এমনকি আরেকটি মহাযুদ্ধের অবতারণা হতে পারে বিশ্বের বুকে। আর দুটি ক্ষেত্রেই লাগাম মূলত যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। কারণ, ইউক্রেন ও ইসরায়েলকে প্রথম থেকেই অর্থ, অস্ত্র; এমনকি নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে দেশটি।
এ অবস্থায় দুয়ারে যখন যুকরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, সরকার পরিবর্তনের সুর, তখন স্বাভাবিকভাবেই আশা আর উৎকণ্ঠার মিশেলে মার্কিন মুল্লুকের দিকে চোখ পুরো বিশ্ববাসীর।
কে হবেন যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট? ১৩২ বছরের রেকর্ড ভেঙে প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখবেন ট্রাম্প নাকি ২৫০ বছর ইতিহাস ভেঙে মার্কিনিরা নিজেদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেবেন একজন নারীকে, যেখানে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতিনিধি কমলা হ্যারিস। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বিরাজমান যুদ্ধ পরিস্থিতি কে কীভাবে সামাল দেবেন বিশ্বে এখন সেটিও আলোচনার বিষয়।
ভোট দিতে যখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন মার্কিনিরা, তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এ নির্বাচনকে পর্যবেক্ষণ করছে পুরো বিশ্ব। মূলত ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে পশ্চিমা বিশ্বের আগামীদিনের কৌশল ও ভূমিকা কী হবে, সেটা নির্ভর করছে এ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। অন্তত, বিশ্লেষকরা এমনটাই মনে করছেন।
বিষয়টি সম্প্রতি প্রতিধ্বনিত হয়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির কণ্ঠেও। যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা সম্ভব কি না, গত সপ্তাহে রাজধানী কিয়েভে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নির্ভর করছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ওপর।’
এর মাধ্যমে শুধু ইউক্রেন নয়, পুরো ইউরোপেরই মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলেও তার উত্তরসূরি হিসেবে এখনও নিজের ওজন ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে রাশিয়া। এর মোকাবিলায় ইউরোপকে ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর।
এ অবস্থায় রাশিয়াকে মোকাবিলায় ভবিষ্যতে ইউরোপের প্রতি ওয়াশিংটনের মনোভাব কী হবে, সেটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপরও অনেকখানি নির্ভর করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
রিপাবলিকান সমর্থিত প্রার্থী ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণাতে খোলাখুলিভাবেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। সেইসঙ্গে ন্যাটোকে আগের মতো সমর্থন যুগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও তার অনীহা স্পষ্ট। যেখানে বাইডেন প্রশাসন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিল পাশ করেছে যুদ্ধে ইউক্রেন ও ইসরায়েলকে কে শক্তি যোগাতে, সেখানে ট্রাম্প এ ব্যাপারটিকে দেখছেন মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ হিসেবে। এ অবস্থায় নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট মনোনীত প্রার্থী কমলা হ্যারিসের জয়লাভের বিকল্প চাইছে না ইউক্রেন ও ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যরা। কারণ একমাত্র কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেই ইউক্রেন ও রাশিয়া প্রশ্নে বাইডেন প্রশাসনের নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা হবে বলে মনে করছে তারা।
বহুদিন ধরেই রাশিয়ার অভ্যন্তরে পশ্চিমাদের সরবরাহ করা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলার অনুমতি চেয়ে আসছেন জেলেনস্কি। তবে এর প্রতিক্রিয়ায় রুশ প্রেসিডেন্টের কঠোর পরিণতির হুঁশিয়ারির পরিপ্রেক্ষিতে এখনও কিয়েভকে এ হামলা চালানো থেকে বিরত রেখেছে হোয়াইট হাউজ। তবে, আবার ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট এলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে শক্তভাবে সমর্থনের সুযোগ তৈরি হবে ন্যাটোর জন্য। এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন আসতে পারে নির্বাচনে জিতে ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করলে। কারণ, তিনি বরাবরই ইউক্রেনকে এ যুদ্ধে সমর্থন দেওয়ার বিরুদ্ধে। এমনকি তিনি চাইলে ‘একদিনের মধ্যেই’ এই যুদ্ধ শেষ করতে পারবেন — এমন ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন। ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, তাদের ঘোরশত্রু রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সরাসরিই নিজের বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কথা জানিয়ে আসছেন ট্রাম্প।
এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে ট্রাম্পের রানিংমেট জেডি ভান্স যেসব পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন, তার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে এ ব্যাপারে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের দেওয়া শর্ত মিলে যাওয়ার বিষয়টিও ইউক্রেনকে আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট বলেই মনে করা হচ্ছে।
সার্বিক বিচারে তাই ইউক্রেনের ব্যাপারে পশ্চিমাদের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল অনেকাংশেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে। অবশ্য ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে ট্রাম্প কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবেন তা নিয়ে সন্দিহান অনেক বিশেষজ্ঞই। যেমন মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রুশ পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ এবং থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’-এর ফেলো থমাস গ্রাহাম বলেন, ‘যদিও ট্রাম্প বলছেন, তিনি দুপক্ষকে আলোচনায় বসাতে পারবেন। তবে তার হাতে এ ব্যাপারে কী কার্ড আছে, সেটা এ মুহূর্তে পরিষ্কার নয়। পাশাপাশি আমি মনে করি, এটা সহজ কোন কাজ হবে না।’
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে সামরিকসহ অন্যান্য সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে এর প্রভাব ইউক্রেনের ওপর ব্যাপকভাবে পড়বে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই বিশ্লেষকদের। এমনকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও বেশ কয়েকবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া রাশিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধ জয় অসম্ভব তাদের জন্য।
এদিকে ইউক্রেন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটার যে কোন লক্ষ্মণকে পশ্চিমা ঐক্যের ভাঙন হিসেবে উপস্থাপন করার সুযোগ ক্রেমলিন লুফে নেবে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া অনুভূত হতে পারে। কারণ ট্রাম্পের এ ধরনের যে কোন পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ভাঙন তৈরি করতে পারে। এছাড়া, ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে অনাস্থা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
এ ব্যাপারে থমাস গ্রাহাম সিএনএনকে বলেন, ‘ইউক্রেন প্রশ্নে পশ্চিমাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ এবং এ যুদ্ধে কী অর্জিত হবে সে ব্যাপারে ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে পরিষ্কার কোন লক্ষ্য নেই। এতে ইউক্রেনে নিজের করণীয় পুনর্বিবেচনা করার ব্যাপারে পুতিনের ওপর কোন চাপ নেই।’
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ঘিরে ইউরোপে অস্থিরতা ছাড়াও আরেকটি যুদ্ধময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইসরায়েল নির্বিচারে তার আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে গাজা ও লেবাননে। এছাড়া যুদ্ধ করছে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত সাতটি ফ্রন্টের বিপক্ষে। এ সবই সম্ভব হচ্ছে যুকরাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ সমর্থনের মাধ্যমে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের চাপে বারবার বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে বাহ্যিকভাবে চাপ দিলেও আদতে অর্থ কিংবা অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করেনি। এমনকি বিশ্ব দরবারে প্রতিবার যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক সমর্থন পেয়েছেন নেতানিয়াহু ও তার প্রশাসন।
এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা সৃষ্টিতে ডেমোক্রেট পার্টির সমর্থন নিয়ে হতাশ অনেক আরব ও মুসলিম আমেরিকান ভোটার যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে বিকল্প খুঁজছেন। তাদের অভিযোগ, পার্টিটি মূলধারার মুসলিম ও আরব আমেরিকানদের মূল্যবোধের সঙ্গে আর সামঞ্জস্য ধরে রাখতে পারছে না।
অবশ্য মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতীত রেকর্ডও মুসলিমদের কাছে খুব একটা ইতিবাচক না। আগের মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ইসরায়েলকে সমর্থন যুগিয়েছেন তিনিও। ডেমোক্রেট পার্টির নীতির সঙ্গে তার ফারাক এটুকুই যে, যুদ্ধের পেছনে অর্থলগ্নিতে উদারতা দেখানোর সম্ভাবনা নেই ট্রাম্পের। এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট হলে হয়তো যুদ্ধ থামানোর জন্য ইসরায়েলকে বাড়তি চাপ প্রয়োগ করতে পারেন তিনি।
আর কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন নীতির ধারায় তেমন কোন পরিবর্তন আসবে না বলে ভয় আরব মুসলিমদের। এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে বিবাদমান পক্ষগুলোর সমঝোতার আলোচনায় বসার সম্ভাবনা আরও একবার ধাক্কা খাবে বলেই বিশ্বাস তাদের।