Tuesday, December 24, 2024

‘মন চাইলেও নতুন কাপড় কেনা যায় না’

আরও পড়ুন

রাত পোহালেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। সবাই ব্যস্ত তালিকা অনুযায়ী ঈদের কেনাকাটা করতে। মার্কেট ও শো-রুমগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সবাই নিজের ও পরিবারের জন্য পছন্দের কেনাকাটায় ব্যস্ত। কারো হয়তো লাখ টাকার কেনাকাটায় মন না ভরলেও নেত্রকোণা সদর উপজেলার মেদনী ইউনিয়নের পশ্চিম মেদনী গ্রামের বাসিন্দা বিলকিস বেগম দুটো পুরাতন মেক্সি কিনেই খুশি।

নেত্রকোণার বড় বাজারস্থ পুরাতন কাপড়ের দোকানে হাসিমুখে কাপড় পছন্দ করছিলেন বিলকিস বেগম। পুরাতন কাপড় কেন কিনছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব সময় তো আর মন চাইলেও নতুন কাপড় কেনা যায় না। খুব অভাবের মধ্য দিয়া জীবন যাইতাছে বাবা। বড় ছেলে মানসিক রোগী, ছোট ছেলেও অসুস্থ হয়ে, ঢাকা ছেড়ে এখন বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে। একজনের কামাই দিয়া কি সবাই খাইয়া বাঁচন সম্ভব বাবা?

এসব বলতে বলতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে বিলকিস বেগমের। মুখ আড়াল করে চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। তার হাতে বাজারের ব্যাগ দেখে মনে হলো, ঈদের কেনাকাটার তালিকার থেকে তিনবেলা খাবারের প্রয়োজনীয় আইটেমের তালিকা বেশি বড়। যাতে রয়েছে অল্প দামের একাধিক শাক-সবজি। তার ঈদের বাজারে নেই মাংস।

৬০ বছর বয়সী বিলকিস বেগম নিজের ও ছেলের বউয়ের জন্য পুরাতন কাপড় কিনলেও নাতিদের জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনেছেন। তিনি বলেন, নিজেদের জন্য না কিনলেও বাচ্চাদের জন্য তো কেনা লাগে। ওরা তো আর অভাব বোঝে না, আমার কাছে বায়না ধরেই। তাই শত কষ্টের মাঝেও বাচ্চাদের জন্য ঈদে নতুন জামা-কাপড় কিনতে আসছি।

জানা গেছে, ৩০ বছর আগে দুই ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রেখে বিলকিস বেগমের স্বামী বুরুজ মিয়া আরেকটি বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। বিক্রি করে দিয়েছেন সব জমি-জমা। শুধু তাই না, বিলকিস বেগমের নামে যে পৈতৃক সম্পত্তি ছিল সেগুলোও বিক্রি করে গেছেন তার স্বামী বুরুজ মিয়া। এতে অবুঝ তিন সন্তান নিয়ে পড়ে যান অথৈই সাগরে। তখন থেকেই সংসারের হাল ধরেছেন বিলকিস বেগম। এখন অন্যর জমিতে একটা ঘর তুলে কোনো রকমে বসবাস করছেন। নিজে খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের কোনো রকমে মানুষ করছেন। সন্তানরা বড় হয়েছে, এখন তার সুখে থাকার কথা। কিন্তু বিধিবাম, বড় ছেলে মোশারফ হঠাৎ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। তাকে নিয়ে এখন তিনি দিশেহারা। ছেলের চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য তার নেই। যেটুকু জমি ছিল বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করিয়েছেন।

আরও পড়ুনঃ  বোনের মেয়ে নিয়ে উধাও স্বামী, প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে অসহায় রাবেয়া

বিলকিস বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বড় ছেলে মানসিক ভারসাম্যহীন মোশারফ মিয়া ঘরের দরজায় অপলক তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন, কোনো উত্তর নেই মুখে। মোশারফের স্ত্রী, এক মেয়ে সন্তান ও মাকে নিয়ে চারজনের সংসার। তার সংসার এখন মা বিলকিস বেগমের ওপর নির্ভরশীল। মোশারফ আগে ঢাকায় একটি গাড়ির শো-রুমে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতেন।

বিলকিস বেগমের ছোট ছেলে মো. কায়কোবাদ মিয়া বলেন, আমার বয়স যখন চার-পাঁচ বছর তখন বাবা আমাদের ছেড়ে অন্য আরেকজনের সঙ্গে সংসার পাতেন। ছোট থেকে মা কষ্ট করে বড় করছে। বড় ভাই হঠাৎ মাথায় সমস্যা হয়ে এখন ঘরে বসে থাকে। আমার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে সন্তান নিয়ে চারজনের সংসার। দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকম দিন পার করছি। আমরা এমন পরিবার বড় হয়েছি যে, কারো কাছে কিছু চাইতেও পারি না, আবার চলতেও পারতেছি না।

আরও পড়ুনঃ  ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য দুঃসংবাদ

তিনি বলেন, আগে ঢাকায় কাজ করতাম। কিছুদিন আগে আমিও অসুস্থ হয়ে বাড়িতে এসে পড়ছি। এখন কোনো রকম দিনমজুরি করে কষ্টে দিনযাপন করছি। প্রতিদিন কাজ থাকে না, যে দিন কাজ পাই না ওইদিন বাজার করাটাই কষ্ট হয়ে যায়। টাকা-পয়সা ছিল যা সব বড় ভাইয়ের চিকিৎসার পেছনে শেষ। আমার একটু জমি আছিল ওইটা ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য বিক্রি করে দিছি। বাচ্চাদের ঈদের জামা দিমু এমন অবস্থা নাই। আমার শ্বশুর অল্প কয়টা টাকা পাঠাইছিল বিকাশে, ওইটা দিয়ে মাইয়া দুইটারে দুইটা জামা কিইনা দিসি। আমরা খুবই অসহায় অবস্থায় আছি। আপনাদের মাধ্যমে যদি কোন রকম কোনো সহযোগিতা পাই, আমরা একটু উপকৃত হব।

বিলকিস বেগমের প্রতিবেশী জাহানারা আক্তার বলেন, আমি আসার পর থেকে দেখতেছি ছেলে-মেয়েগুলোরে এই মহিলা খুব কষ্ট করে বড় করছে। আত্মীয়-স্বজন যারা আছে তারাও আর্থিকভাবে অসচ্ছল। আগে বড় ছেলেটা কাজ করতে পারতো এখন তো এক ভাইয়ের আয়ের ওপর সংসার নির্ভর করে। সংসারে আর কাজ করার মতো কেউ নাই। আমরাও গরিব। আমার স্বামী রিকশা চালায় এটা দিয়া কোনো রকম খাইয়া যাইতে পারি। আমি নিজে অভাব-অনটনের মধ্যে থাকি, আমারও সামর্থ্য নাই। এই ছেলেটার এমন রোগ হয়েছে, এটা কবে সুস্থ হয় কোনো গ্যারান্টি নাই। আর তার চিকিৎসা করার মতো তাদের আর্থিক অবস্থাও নাই।

একই গ্রামের বাসিন্দা মো. শাহ আলম জানান, তাদের পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ, দিন আনে দিন খায়। কাজ থাকলে খাইতে পারে, কাজ না থাকলে দেখা যায় না খাইয়া থাকা লাগে। তারা খুব একটা অসহায় অবস্থার মধ্যে দিন পার করতেছে। এক সময় তাদের আর্থিক অুবস্থা ভালো ছিল কিন্তু, তার বাবা চলে যাওয়ার পর তারা খুব অভাবের মধ্যে পড়ে গেছে। দুই ভাই আয়-রোজগার করতে পারলে তারা সুখে থাকতে পারতো। কিন্তু বড় ভাইটা মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়াতে বড় একটা সমস্যার মধ্যে তারা পড়ে গেছে।

আরও পড়ুনঃ  ‘ভবনে ভেন্টিলেশন ছিল না, নিহতরা ধোঁয়ায় মারা গেছেন’

মেদনী ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. আলকাস মিয়া বলেন, আমি তাদের পরিবার সম্পর্কে জানি, আর্থিক অবস্থা খুব নাজুক। তারা খুবই কষ্টে দিন পার করতেছে। বিলকিসের স্বামী বুরুজ মিয়া অনেক বছর আগে তাদের রেখে অন্য একটা মহিলাকে বিয়ে করে সেখানে সংসার করতেছে। শুনেছি সে এখন সিলেটে থাকে দ্বিতীয় পরিবারের সাথে। এই ফ্যামিলি ছেড়ে যাওয়ার আগে তার এবং বিলকিসের যত জমি-জমা ছিল সব বিক্রি করে টাকা নিয়ে চলে গেছে। ওই পরিবারে তাদের সন্তানও আছে। তাদের বিয়ে-শাদি করাইছে। বুরুজ মাঝে মাঝে এদিকে আসলে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু প্রথম পরিবারের দিকে নজর দেয় না।

তিনি আরও বলেন, পরিবারটা খুবই কষ্ট করতেছে। একটা ছেলে মানসিক রোগী, আরেকটা ছেলের আয়ের ওপর পুরো সংসার চলে। তার মা তেমন কিছু করতে পারে না, বাড়িতে দু-একটা হাঁস মুরগি পালন করে। এভাবে কষ্ট করে দিন পার করতেছে তারা। কোনোভাবে এই পরিবারটাকে একটু সহযোগিতা করতে পারলে তারা খুবই উপকৃত হতো। মোশারফের একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে তাদের জীবনটা একটু ভালো কাটতো।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ