Tuesday, December 24, 2024

২৫ বছর ধরে করেন ইমামতি, এখন বেতন পান ১৫০০ টাকা

আরও পড়ুন

বন্যা, খরা, শীত, ঝড়-বৃষ্টিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দায়িত্ব পালন করেন মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা। তবে তারা মসজিদ কমিটি থেকে যে সম্মানী পান তাতে সংসার চলে না। ভালো কোনো খাবার কিনতে পারেন না। আর্থিক সংকটে ছেলে-মেয়েদের ভালো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পড়াতে পারেন না তারা। পরিবারের চাহিদা মেটাতে কেউ কেউ পাশাপাশি অন্য কর্মও করেন। ফলে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা সরকারিভাবে বেতন-ভাতা দাবি করেছেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা শহরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি তালিকা অনুযায়ী ৫ হাজার ২৭৪টি মসজিদ রয়েছে। এতে ইমাম ও মুয়াজ্জিন মিলে জনবল প্রায় ১০ হাজার জন। অন্যদিকে জেলার ৯টি উপজেলায় ৯টি মডেল মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে ৪টি মডেল মসজিদের উদ্বোধন করা হয়েছে। মডেল মসজিদে একজন ইমাম, একজন মুয়াজ্জিন ও দুজন করে খাদেম রয়েছে। শুধুমাত্র তারা সবাই সরকারিভাবে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন।

এছাড়াও শহরাঞ্চলের অন্যান্য মসজিদগুলোর ইমাম-মুয়াজ্জিনদের একটা নির্ধারিত বেতন-ভাতা রয়েছে। তবে গ্রামের মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভাগ্যে জুটছে না আর্থিক কোনো সুযোগ-সুবিধা। এলাকার মসজিদ কমিটির সদস্য ও মুসল্লিদের দেওয়া অল্প পরিমাণে আর্থিক সাহায্যে হচ্ছে তাদের বেতন-ভাতা। আবার কেউ কেউ নিয়মিত বেতন পান না। ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে ইমাম ও মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে সামান্য বেতনে জীবন চলছে তাদের।

যেকোনো মিষ্টি খাবারের রেসিপিতে থাক, প্রাকৃতিক ও নিরাপদ জিরোক্যাল-এর মিষ্টি স্বাদ

গ্রামাঞ্চলের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা জানান, শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে তারা দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। কিন্তু উপযুক্ত বেতন না পাওয়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে অতিকষ্টে জীবনযাপন করছেন তারা। ঠিকমতো পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে পারেন না। রমজান মাসে ফলমূল তো দূরের কথা ভালোমতো ইফতার ও খাবারও ভাগ্যে জোটেনি অনেক ইমাম-মুয়াজ্জিনের পরিবারে।

এমনই একজন মসজিদের ইমাম কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের উত্তর সিতাই ঝাড় মিয়াজিপাড়া এলাকার হাফেজ মো. কাউছার আলী। গত ২৫ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন মসজিদে ইমামতি করছেন। বর্তমানে ওই ইউনিয়নের কলেজ মোড় বাজার মসজিদের ইমামতি দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। তার পরিবারে সদস্যের সংখ্যা ছয়জন। পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। প্রথমদিকে মসজিদ থেকে মাত্র ৫০০ টাকা সম্মানি ভাতা পেলেও এখন পাচ্ছেন দেড় হাজার টাকা। পাশাপাশি করছেন মসজিদভিত্তিক শিক্ষা প্রকল্পে শিক্ষকতা। সেখানে বেতন পাচ্ছেন ৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে মাসে আয় সাড়ে ৬ হাজার টাকা।

আরও পড়ুনঃ  ঈদের দিন বাংলা মদ খেয়ে তিন বন্ধুর মৃত্যু

সাড়ে ৬ হাজার টাকা বেতনে সংসার কেমন চলছে জানতে চাইলে হাফেজ মো. কাউছার আলী বলেন, আমি প্রায় ২৫-৩০ বছর ধরে ইমামতি করছি। বাংলাদেশে সব মানুষের দাম আছে, কিন্তু মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের দাম নাই। সমাজেও দাম নাই, সরকারের কাছেও দাম নাই। ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা যে বেতন পান, তাতে চা ও পান খাওয়ারই টাকা হয় না। এ দিয়ে কীভাবে একটা সংসার চালানো সম্ভব। তাই অনেক কষ্টে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা দিনযাপন করেন। তাদের কষ্ট আছে, আজীবন থাকবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা ইমামরা কীভাবে যে দিনপার করি, অন্য কেউ জানবে না। শুধু আমরাই জানি আমাদের কষ্টের কথা। এমন ভাবে চলাফেরা করছি, কারও কাছে চাইতেও পারছি না, ঠিকমতো খাইতেও পারছি না। আমার পরিবারে সবাই রোযা রাখে। একদিনও ১০ টাকার ইফতার কিনে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি নাই। এর মতো দুঃখ আর কী আছে। সরকার যদি আমাদের দিকে সুনজর দিলে হয়তো একটু ভালো থাকতে পারতাম আমরা।

সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের সরদারপাড়া জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন গিয়াস উদ্দিন (৫৫)। তার দুই ছেলে দুই মেয়েসহ ছয় সদস্যের সংসার। মেয়ে জেসমিনের (২০) বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে বেলাল হোসেন (১৫) জেলার উলিপুর উপজেলা গড়াইপিয়ার মাদরাসায় পড়ছে। ছোট মেয়ে জুঁই (১০) ও ছেলে জিম (৪) বাড়িতেই থাকছে। তিনি ওই মসজিদে ৭ বছর থেকে মুয়াজ্জিনের দায়িত্বে রয়েছেন। সেখানে বেতন পান মাত্র ২ হাজার টাকা। এই মুয়াজ্জিনের অন্য কোনোভাবে আয় রোজগারের সুযোগ নেই।

ঢাকা পোস্টকে মুয়াজ্জিন গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমি এখানে সম্মানী পাই ২ হাজার টাকা। মন চাইলেও ভালোমন্দ কিনে খেতে পারি না। সংসার চলছে না, খুব কষ্ট। আমার সংসার চালাতে ১০ হাজার টাকা লাগে। এক বিঘা জমি ছিল তাও বন্ধক রাখা আছে। ফলমূল তো দূরের কথা ঠিকমতো খেতে পারছি না। রমজান মাসতো শেষের দিকে। একদিনও মাংসও কিনতে পারিনি। আমার অন্য কোনো কর্মও নাই। কীভাবে যে চলছি একমাত্র আল্লাহ পাকই জানেন।

আরও পড়ুনঃ  নিখোঁজের ৪ দিন পর সেপটিক ট্যাংকে শিক্ষার্থীর মরদেহ, আটক ২

কুড়িগ্রামের আরাজি ভোগডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মো. আয়নাল কবির (৪৫)। তিনি কুড়িগ্রাম ধরলা ব্রিজ পূর্ব পাড় বাজার জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন। গত ২০ বছর যাবৎ মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কর্মরত রয়েছেন তিনি। তার পরিবারে তিন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। তার ছেলে রাহাত (১৭), স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, মেয়ে আমিনা আক্তার (১৩) স্থানীয় মাদরাসায় পড়ছে, ছেলে রিফাদ (৮) নুরানি মাদরাসার ছাত্র ও আরাফাত (৬) বাড়িতে থাকে। আয়নাল কবির সংসারের হাল ধরতে মুয়াজ্জিনির পাশাপাশি করছেন পাউরুটির ব্যবসা। ব্যবসা সামাল দিয়ে পালন করছেন মসজিদের দায়িত্বও।

মুয়াজ্জিন আয়নাল কবির বলেন, আমি দীর্ঘদিন কোনো প্রকার সম্মানী ছাড়াই মসজিদে দায়িত্ব পালন করেছি। তবে কয়েক বছর থেকে ৩ হাজার টাকা প্রতি মাসে সম্মানী পাচ্ছি। ছয় সদস্যের সংসারে তিন হাজার টাকা দিয়ে সংসার চালানো কোনোভাবেই সম্ভব না। এ কারণে আমি বেকারি থেকে বিভিন্ন মালামাল নিয়ে এসে দোকানে দোকানে সেল করি। এ থেকে যা পাই তা দিয়ে সংসারে যোগান দেই। তারপরও এভাবে সংসার চলছে না। প্রতি মাসে ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ প্রায় ২০ হাজার টাকা লাগে। এর মধ্যে মসজিদ থেকে ৩ হাজার, আর রুটি-বিস্কুট বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েও চলে না।

শুধু ইমাম হাফেজ মো. কাউছার আলী, মুয়াজ্জিন আয়নাল কবির ও মুয়াজ্জিন গিয়াস উদ্দিন নন, তাদের মতো শত শত ইমাম-মুয়াজ্জিন অতিকষ্টে দিন অতিবাহিত করছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে বেতন-ভাতার আওতায় আনা যায় তাহলে হয়তো হাজারো পরিবারের মুখে হাসি ফুটবে। আরও যত্নবান হয়ে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।

আরও পড়ুনঃ  সুন্নতে খতনার সময় শিশুর পুরুষাঙ্গ বিচ্ছিন্ন, ঢামেকে প্রতিস্থাপন

মুসল্লি শফিকুল ইসলাম বলেন, একজন সাধারণ মুসল্লি হিসেবে আমার ধারনা আমরা মসজিদ থেকে ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের যে সম্মানী ও ভাতাটা দেই তা দিয়ে কিন্তু তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো কোনোভাবেই পূরণ হচ্ছে না। সমাজের প্রতি আমাদের সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা পায়। তাহলে একটু হলেও সুখে শান্তিতে দিন অতিবাহিত করতে পারবেন তারা। পাশাপাশি সরকার যদি ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের নিয়ে একটু চিন্তা করে, মাসিক একটা ভাতার ব্যবস্থা করে তাদের জন্য, তখন হয়তো দুবেলা দুমুঠো পরিবার পরিজন নিয়ে খেতে পারবেন তারা।

কুড়িগ্রাম কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব আলহাজ হযরত মাওলানা এ কে এম মোছলেহ উদ্দিন আজাদি বলেন, মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা অনেক কষ্টে জীবনযাপন করেন। ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের সরকারিভাবে বেতন ভাতার আওতায় আনা গেলে সবচেয়ে ভালো হতো। তখন আগ্রহ উদ্দীপনা অনেক বৃদ্ধি পেত। আমি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়েছি মাহফিলে কয়েকবার। সেখানে দেখেছি ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের সরকারিভাবে বেতন ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুশফিকুল আলম হালিম বলেন, মডেল মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা তো সরকারিভাবে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। সরকারিভাবে যদি অন্যন্য ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের টিসিবির চালের আওতাসহ দুই ঈদে দুবার বেতন-ভাতার আওতায় আনা যায় তাহলে হয়তো ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা ভালোভাবে ঈদ পালন করতে পারতেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. মারুফ রায়হান বলেন, কুড়িগ্রাম জেলায় যত মসজিদ রয়েছে সেখানকার ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা সরকারিভাবে কোনো ভাতা বা সম্মানী পান না। শুধুমাত্র জেলার ৪টি মডেল মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা সরকারিভাবে বেতন-ভাতার আওতায় এসেছে। বাকি মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা যেন বেতন-ভাতা পায় এজন্য আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে লেখালেখি করছি। আমরা আসলে জানি ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা অতিকষ্টে জীবনযাপন করে আসছেন। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ