Monday, December 23, 2024

ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী থেকে ভূমিদস্যু নাজিমুদ্দিন

আরও পড়ুন

তার বেশভূষা দেখলে যে কেউ মনে করবে মস্ত বড় আলেম। স্থানীয়দের কাছে নিজেকে পরিচয়ও দেন মাওলানা হিসেবে। সবসময় থাকেন ধর্মীয় লেবাসে। জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও করেন কখনো-সখনো। তবে বাস্তবজীবনে ঠিক উল্টো। দুই ডজন মামলার আসামি কথিত এই মাওলানা। তিনি কাউকে পরোয়া করেন না।

ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনার সময় রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে করেছেন লাঞ্ছিত, দলবল নিয়ে পিটিয়েছেন কর্মকর্তাদের। থানা পুলিশ তার কাছে ডাল-ভাত। গ্রেপ্তারও হয়েছেন, তবে জামিনে বের হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে বাড়িয়েছেন দখল সাম্রাজ্য। অন্যের জমি দখল ও ব্যবসা করে মাত্র পাঁচ বছরেই বনে গেছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। দখলে সিদ্ধহস্ত এই কথিত মাওলানার নাম মো. নাজিমুদ্দিন ভূঁইয়া ওরফে আরজু।

জানা গেছে, নাজিমুদ্দিনের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার জন্ম ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে। ২০১০ সালের দিকে তিনি রাজধানীতে আসেন। রামপুরার একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। তখন জড়িয়ে পড়েন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে। পরে ভাসানটেক এলাকায় ভাঙাড়ি ও থাই গ্লাসের ব্যবসা করেন। ক্যান্টনমেন্ট থানা জামায়াতে ইসলামীর রোকন সদস্যও নির্বাচিত হন। ভাঙাড়ির ব্যবসা করতে গিয়ে পরিচয় হয় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে।

পরে শুরু করেন আবাসন ব্যবসা। তৈরি করেন নিউগিনি প্রোপার্টিজ লিমিটেড নামের একটি আবাসন কোম্পানি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। স্থানীয় প্রভাবশালী এবং ক্যান্টনমেন্ট থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হাজি আব্বাসের ছত্রছায়ায় শুরু করেন জমি দখল। এখন তিনি মস্ত বড় আবাসন ব্যবসায়ী। যদিও ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় নাজিমুদ্দিন ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত।

আরও পড়ুনঃ  চিনিকাণ্ডে পদ হারালেন বিএনপির দুই নেতা

স্থানীয়রা জানান, নাজিমুদ্দিন এক পর্যায়ে নিজেকে গুলশান আজাদ ইউনিট আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পরিচয় দেওয়া শুরু করেন। এরপর নাজিমুদ্দিনকে চেনেন না এবং তিনি গুলশান আজাদ ইউনিট আওয়ামী লীগের কমিটিতে নেই জানিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। গত বছরের ১৪ নভেম্বর গুলশান আজাদ ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজি মো. সাহিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক মো. আরিদুল ইসলাম যৌথ স্বাক্ষরে এই বিজ্ঞপ্তি দেন।

দখলে সিদ্ধহস্ত নাজিমুদ্দিন: জোয়ারসাহারা মৌজায় নাজিমুদ্দিন প্রায় ১৪ বিঘা জমি দখল করে রেখেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার কালো থাবায় বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পথে অসংখ্য মানুষ। এ ছাড়া কয়েকজন সামরিক- বেসামরিক বাহিনীর কর্মকর্তার জমিও জোর করে দখলে নিয়েছেন তিনি। নিজের জমিতে গিয়ে মারধরেরও শিকার হয়েছেন সেনাবাহিনীর এক সাবেক কর্মকর্তা। এ ঘটনায় সাবেক ওই কর্মকর্তা মামলা করেছেন। এখনো তার জমি ফিরে পাননি। নাজিমুদ্দিনের দখল করা জমির মধ্যে রয়েছে বোরহান উদ্দিনের নিজ বসতবাড়ির ৩ দশমিক ৩৭ কাঠা জমি, শরফত মোল্লার ৩১ দশমিক ৮২ কাঠা, মইদুর আলীর ওয়ারিশ মোছা. হালিমা খাতুনের ৩ কাঠা, ইকবাল হোসেন গংদের আমমোক্তারনামা মালিক মো. আক্তারুজ্জামানের ১৫ দশমিক ৭৬ কাঠা, শামিমা ইসলাম গংয়ের ১৪ দশমিক ০৬ কাঠা, সাজেদুর রহমানের ৩ কাঠা, সাকুরা সাবেরের আমমোক্তারনামা মালিক মো. আক্তারুজ্জামানের ৩ দশমিক ৫০ কাঠা, মো. মোশারফ হোসেন, মো. ফখরুল ইসলাম ও মোসা. শিউলি আক্তারের ৬ কাঠা, সৈয়দ মাহবুবুল গনির আমমোক্তারনামার মালিক মো. মোখলেছুর রহমানের ৭ দশমিক ৮৭ কাঠা, মো. হারুন রশীদ গংদের ৯ দশমিক ১৫ কাঠা, মোছা মোখলেছুর রহমানের আর এক দাগে ১৩০ দশমিক ৮৫ কাঠা এবং খান মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামানের ২২ দশমিক ১৮ কাঠা জমি দখলে রেখেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুনঃ  স্বামীর ‘ডামি’ স্ত্রী, মায়ের ‘ডামি’ মেয়ে

রাজউকের ম্যাজিস্ট্রেট লাঞ্ছিত: নিউগিনি প্রোপার্টিজ লিমিটেডের নামে রাজউকের অনুমোদন না নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানার জোয়ারসাহারা মৌজায় মানিকদী এলাকায় ভবন নির্মাণ করছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার নাজিমুদ্দিন ভূঁইয়া। পরে রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে কাজ বন্ধের নির্দেশ দেন এবং ভবনের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নাজিমুদ্দিন ও তার লোকজন রাজউক কর্মকর্তাদের মারধর করেন। এ ঘটনায় গত ৯ এপ্রিল রাজউকের ইমরাত পরিদর্শক শেখ আতিফ হোসেন ইমন রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা করেন।

জানতে চাইলে রাজউকের ইমারত পরিদর্শক শেখ আতিফ হোসেন ইমন কালবেলাকে বলেন, ‘রাজউকের অনুমোদন না নিয়ে ভবন নির্মাণ করায় আমরা সেখানে অভিযান চালিয়েছিলাম। অভিযান চলাকালে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে তারা আমাদের লোকজনকে মারধর করে।

৫ বছরে অঢেল সম্পদ: একসময় ভাঙাড়ির ব্যবসা করা নাজিমুদ্দিন মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে দেশজুড়ে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। তার উল্লেখযোগ্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর জোয়ারসাহারা মৌজায় সিএস এবং এসএ ৬১০, ৬১১, ৬১২, ৬১৩, ৬১৪, ৬১৫, ৬১৬ ও ২৬৫ দাগে প্রায় ১৭ বিঘা জমি, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাউনিয়া মৌজায় সিএস ও এসএ-২৫৭ দাগে ১০ বিঘা জমি, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুনঃ  স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

মিরপুর ডিওএইচএসে ৪০০০ বর্গফুটের ২টি ফ্ল্যাট, মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা; মিরপুর ডিওএইচএস রোডে সিটি কাবাবের ৫ কাঠা জমি, যার মূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা; লাল মিয়ার টেক মানিকদী ৫ কাঠা জমির ওপর বহুতল ভবন, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা; বসুন্ধরা এ, বি এবং এন ব্লকে ৩টি প্লট ও ১টি ফ্ল্যাট, যার মূল্য প্রায় ৭ কোটি টাকা; গ্রামের বাড়িতে রয়েছে প্রায় ৮০ বিঘা জমি। এ ছাড়া নাজিমুদ্দিনের দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান এবং মালয়েশিয়ায় ২টি দোকান ও ১টি তেলের পাম্পে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে মো. নাজিমুদ্দিন ভূঁইয়া সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এসব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমি কারও জমি দখল করিনি। জমি দখলের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’ ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধরের বিষয়ে বলেন, রাজউকের অভিযানের সময় ৪০-৫০ জনের বাহিনী নিয়ে তারা অভিযান চালিয়েছে, তাদের আমরা মারধর করেছি—এটা কি বিশ্বাসযোগ্য। জমিজমার বিষয়ে বলেন, আমার শুধু ৩ কাঠা জমিতে একটি টিনশেড বাড়ি আছে। এ ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই। আমি যাত্রাবাড়ী, রামপুরা মাদ্রাসায় পড়েছি। এরপর হক-হালালিভাবে ব্যবসা করছি।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ