যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে অবিরাম সংগ্রাম হচ্ছে মায়েদের। নিজের বুকের ধন হারানোর উৎকণ্ঠায় দিনরাত পার করতে হচ্ছে তাদের। নিজ ভূমিতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কিংবা সন্তান নামক জ্বলতে থাকা আশার শেষ আলোটুকু জ্বালিয়ে রাখাই যেন তাদের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম।
অবরুদ্ধ গাজায় তেমনই সংগ্রামী এক মা আমাল আলাবাদলা। ইসরাইলের আগ্রাসনের সূচনা থেকেই আমাল তার দুই সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছেন।
গত বছরের ৭ অক্টোবর সকাল। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্থপতি আমাল আলাবাদলা তার ১৮ মাস বয়সী আরেক সন্তান নোয়াহকে সঙ্গে নিয়ে শুয়ে ছিলেন। এমন সময় পাশেই হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ। সেই শব্দে জেগে ওঠেন আমাল।
দখলদার ইসরাইল সীমান্তে হাজার হাজার রকেট নিক্ষেপ করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এরপরই ইসরাইলের ফাইটার জেট হাসাম নিয়ন্ত্রিত গাজায় উপত্যকায় সাড়াশি হামলা শুরু করে।
খান ইউনিসের বাসিন্দা আমালের কোনো ধারণা ছিল না কি হতে যাচ্ছে! তিনি উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। ওই সময়েই তার প্রচুর রক্তপাত শুরু হয়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি জরুরি হয়ে পড়ে।
কিন্তু তখন তার স্বামী বাসায় নেই। গাজার বাইরে কাজ করতে গেছেন। ফলে তিনি একা। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পরে তিনি প্রথম ট্যাক্সি পান। তবে চালক তাকে সামান্য এগিয়ে নিয়ে যান। রাস্তাগুলো ছিল লোকে লোকারণ্য।
তারা কোথায় যাবেন, কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এক সময় তারা হাসপাতালে পৌঁছান। পোঁছানোর পরই আমালকে অবিলম্বে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে আমালের ছেলে মোহাম্মাদের জন্ম হয়। সেদিন থেকে আমাল তার দুই সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিদিন আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছেন।
ইসরাইলের আগ্রাসনের মাঝে গাজার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের মতো আমাল ও তার পরিবারের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তিনি ও তার দুই শিশু সন্তান স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত।
গাজার উত্তরাঞ্চলে এই সমস্যা আরও তীব্র। যেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু এবং প্রায় ৯৫ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারীই গুরুতর খাদ্য সংকটের মুখে। চলতি মাসের শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানায়, গাজার উত্তরাঞ্চলে হাসপাতালগুলোতে অসংখ্য শিশু অনাহারে মারা যাচ্ছে। গাজার দক্ষিণেও শিশুখাদ্য পাওয়াও অনেক কঠিন।
এছাড়া জাতিসংঘ শিশুদের বুকের দুধ পান করানোর ওপর অধিক গুরুত্ব দিলেও গাজার প্রায় অর্ধেক নারীই ছয় সপ্তাহের বেশি সময় শিশুদের বুকের দুধ পান করাতে পারছেন না।
এমন জরুরি পরিস্থিতিতে শিশু পুষ্টি বিষয়ক ইউনিসেফের সিনিয়র উপদেষ্টা আনু নায়ারান বলেন, ‘সংঘাত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আশঙ্কা করেছিলাম এমন একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।’
যুদ্ধ যত এগিয়েছে পরিস্থিতি ততটাই জটিল হয়েছে। গাজায় পানির খুবই ঘটতি দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ নতুন মায়ের পানিশুন্যতায় ভুগছেন। এ কারণে তাদের পর্যাপ্ত বুকের দুধ তৈরি হচ্ছে না।
এমন জটিল অবস্থায় আমাল মাত্র এক মাস তার শিশুকে বুকের দুধ পান করাতে পেরেছিলেন। অপুষ্টির কারণে পর্যাপ্ত দুধ তৈরি হচ্ছিল না। আমাল বলেন, ‘আমি সবসময় ভয়ে ছিলাম। আমি নিজের জন্য ভালো খাবার সংগ্রহ করতে পারছিলাম না। তাই আমার বুকে সন্তানের জন্য দুধ তৈরি হত না। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি।’
আনু নায়ারান বলেন, ‘লোকেরা দিনে দুই লিটারের কম পানি পাচ্ছেন, যা খাওয়া ও ধোওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পানির তুলনায় খুবই কম।’ এছাড়াও গাজায় শিশু খাদ্যও পর্যাপ্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ জরুরি সাহায্য হিসেবে শিশুখাদ্য পাঠিয়েছে। কিন্তু যতগুলো ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে তার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
তাছাড়া উভয় পক্ষের লড়াই ও অরাজক পরিস্থিতির কারণে সেসব ত্রাণ বোঝাই ট্রাক হয় বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়েছে না হয় লুটপাট হয়ে গেছে। এদিকে ইসরাইলি অবরোধ ও বাঁধার কারণে নতুন করে ত্রাণ সহায়তাও গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না।
যদিও বিষয়টি অস্বীকার করছে ইসরাইল কর্তৃপক্ষ। উল্টো ত্রাণ সংস্থাগুলোর দোষ চাপিয়ে বলেছে, সংস্থাগুলোই প্রয়োজন মতো সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
তবে বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। শুক্রবার (১৫ মার্চ) অস্ট্রেলিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রী পেনি অং বলেন, সীমান্ত ক্রসিংগুলোর বাইরে খাদ্য বোঝাই বহু ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেগুলোকে গাজায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেনম, ইসরাইলি সহযোগিতা ছাড়া এসব খাদ্য সীমান্ত পেরিয়ে গাজায় প্রবেশ এবং বিতরণ করা অসম্ভব। আমরা ইসরাইলকে এখনই গাজায় এসব ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেয়ার অনুরোধ করছি।’
গাজায় বিশুদ্ধ পানির অভাবে ইউনিসেফ প্রি মিক্সড তথা আগেই প্রস্তত করা শিশুখাদ্য পাঠাচ্ছে। এটি ব্যবহার করা নিরাপদ হলেও অধিক পরিমাণে পরিবহণ করা কঠিন।
এদিকে সিজারে বাচ্চা জন্ম দেয়ার পর সুস্থ হতে না হতেই প্রথমবার উদ্বাস্তু হন আমাল। এরপর মায়ের বাড়িও ছাড়তে হয় তাকে। চতুর্থবারের মতো যখন তারা বাস্তুচ্যুত হন তখন মধ্যরাত। বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার দুই ঘণ্টা পরই সেখানে বোমা ফেলা হয়।
আমাল বলেন, ‘বোমা হামলায় পুরো বাড়িটি মাটিতে ধসে পড়ার কারণে আমি দুধ ও ডায়াপার সঙ্গে নিতে পারিনি। উদ্বাস্তু হওয়ার পর আমাল তার শিশু সন্তানদের নিয়ে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিলেন গাজার দক্ষিণে রাফায় আশ্রয় নেন। ভেবেছিলেন, রাফা তার সন্তানদের জন্য নিরাপদ হবে।
কিন্তু তাকে সেই রাফাও ছাড়তে হয়। এরপর তিনি আশ্রয় নেন খান ইউনিস এলাকায়। আমালের শিশু সন্তান মোহাম্মদের দুধজনিত এলার্জি রয়েছে। সাধারণ শিশুখাদ্যে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিকল্প হিসেবে একটি খাবারের সন্ধান পেলেও তার দাম অনেক। সংঘাত শুরুর আগে যার দাম অন্তত দশগুণ কম ছিল।
জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিবারটি খান ইউনিসের বাইরে একটি উন্মুক্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছিল। এই রিপোর্ট লেখার সময় আমালের শিশুর জন্য মাত্র দুই দিনের খাদ্য মজুদ ছিল। এছাড়া তিন মাস বয়সী মোহাম্মদের জন্য খাওয়ার আর কিছুই ছিল না।
এমতাবস্থায় আমাল আবারও বাজারের সন্ধানে রাফায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে যেতে সাধারণত গাড়িতে মাত্র ২০ মিনিট সময় লাগে। তবে ইসরাইলি বাহিনী সেই রাস্তায় অবস্থান করছিল। যাত্রাপথে আমাল অন্তত তিনটি ট্যাংকের দেখা পান। একটি তাদের উদ্দেশে করে গুলি চালায় এবং সেই গুলি তাদের গাড়ির কাছে এসে পড়ে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে খান ইউনিসে যুদ্ধ আরও তীব্র হয়। বোমা বিস্ফোরণের শব্দ নোয়াহ’র জন্য সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। তার মৃগীরোগ ছিল এবং বোমার শব্দে তার খিঁচুনি আরও তীব্র আকার ধারণ করে।
কিন্তু তার ওষুধ কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না আমাল। তার পরিবার আল-মাওয়াছি উপকূলীয় এলাকায় একটি তাবুতে ছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহের শেষে এলাকাটিতে গোলাবর্ষণের কারণে তাদের সেখান থেকে সরে যেতে হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধের শুরু থেকে গাজায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২৪ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে। পুরো উপত্যকার মানুষ এখন তীব্র খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। ছোট শিশুদের জন্য তা আরও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।
ইউনিসেফের সিনিয়র উপদেষ্টা আনু নায়ারান বলেন, ‘শিশুরা খুব দ্রুত অসুস্থ হতে পারে। তাদের দেহে চর্বি ও পেশির পরিমাণ কম থাকে। ফলে তাদের দ্রুত অপুষ্টিতে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এই অপুষ্টির কারণে তাদের ভবিষ্যত জীবনে ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ ও স্থূলতার হার বাড়তে পারে।’
আমাল আপাতত তার ছেলের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। তিনি একই এলাকায় আরও কয়েকজন মায়ের খোঁজ পান যারা তাদের নিজেদের শিশুর পাশাপাশি আমালের শিশু সন্তানকেও তাদের বুকের দুধ পান করান। আমাল সামান্য টাকা ও শিশুর জামাকাপড় দিয়ে এই ঋণ শোধ করেন।
আমালরা এখন ভূমধ্যসাগর উপকূলের আল-মাওয়াসি এলাকায় বালির ওপর তাবু গেড়ে বসবাস করছেন। সেখানে তারা ত্রাণের আটার রুটি ও ও টিনজাত খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করছেন। যুদ্ধের শুরুর দিকেই আল মাওয়াসিকে ইসরাইলি বাহিনী ‘মানবিক এলাকা’ ঘোষণা করে।
তবে এই আশ্রয় শিবিরও বেশিদিন স্থায়ী হবে না বলেই মনে হচ্ছে। কারণ গত রোববার আমালদের আশ্রয় শিবিরে বোমা হামলা চালানো হয়। ফলে আরও একবার তাদের বাস্তুচ্যুত হতে হয়। হামলায় তাদের পাশের তাঁবুতে অন্তত চারজন নিহত হয়।
আমাল ছবি তুলতে ভালবাসেন। কিন্তু গত ছয় মাসে তিনি একটি ছবিও তুলতে পারেননি। শেষ ছবিটি তুলেছেন যুদ্ধ শুরুর একদিন আগে ৬ অক্টোবর। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ছেলে নোয়াহ নরম গালিচায় শুয়ে টিভিতে কার্টুন দেখছে। দেখতে দেখতে বোতল থেকে দুধ পান করছে।
সেই রাতে ছেলে নোয়াহ তাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই রাতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমাল বলেন, ‘আমার পক্ষে যা করা সম্ভব, করেছি। এই ভয়ংকর যুদ্ধ থেকে আমার সন্তানদের উদ্ধার করতে হবে।’